শনিবার, ১৬ জানুয়ারী ২০২১, ০৯:৩৭ পূর্বাহ্ন
সাইবার নিউজ একাত্তর অনলাইন ডেস্ক :
যেখানে তার দায়িত্ব ছিল জেলখানায় আটক কয়েদীদের নিরাপত্তা দেয়া, সেখান থেকে কোনো অপরাধী যাতে পালিয়ে যেতে না পারে বা জেলখানার অভ্যন্তরে কোনো বিশৃঙ্খলা সৃষ্টি করতে না পারে তার উপর কড়া নজর রাখা। সেখানে যাতে বেআইনি কোন কারবার কেউ সংঘটিত করতে না পারে তাও নিশ্চিত করার দায়িত্ব ছিল জেলারের। এসব গুরুদায়িত্ব যার ওপর অর্পিত ছিল, তিনি নিজেই এখন কয়েদখানায় বন্দী। অপরাধীদের সংশোধনাগার জেলখানার কর্মকর্তাটি এখন অপরাধী হিসেবে করছেন হাজত বাস।
আমরা চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের জেলার সোহেল রানা বিশ্বাসের কথাই বলছি। গত ২৭শে অক্টোবর ২০১৯ ইং দৈনিক জাতীয়ও, স্থানীয় বিভিন্ন পত্রিকায় এমন কি টিভি চ্যানেলে ফেন্সিডিল, নগদ টাকা, ব্যাংকের চেক এবং এফডিআরের কাগজপত্রসহ চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারের জেলার সোহেল রানা বিশ্বাসের গ্রেফতারের খবর প্রকাশিত হওয়ার পর জনমনে চাঞ্চল্যের সৃষ্টি হয়েছে। সরকার যেখানে বিশ্বাস করে সোহেল বিশ্বাসকে যে গুরু দায়িত্ব দিয়েছিল, তিনি তা ভঙ্গ করেছেন। বলা যায় রাষ্ট্রের সাথে বিশ্বাসঘাতকতা করেছেন। খবরে বলা হয়েছে, ১২ বোতল ফেন্সিডিল, নগদ ৪৪ লাখ টাকা, বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান থেকে নেওয়া ১ কোটি ৩০ লাখ টাকার চেক, তার স্ত্রীর নামে বিভিন্ন ব্যাংকের আড়াই কোটি টাকার এফডিআরের কাগজপত্রসহ সোহেল বিশ্বাসকে গত ২৬শে অক্টোবর ভৈরব রেলওয়ে পুলিশ আটক করে। তিনি চট্টগ্রাম থেকে ময়মনসিংহগামী ট্রেন বিজয় এক্সপ্রেসে চড়ে গ্রামের বাড়িতে যাচ্ছিলেন। ভৈরব রেলওয়ে পুলিশ তাকে আটক করে ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষকে জানালে তাকে গ্রেফতার করা হয়। বর্তমানে তিনি কারাঅভ্যান্তরে আছেন। তার বিরুদ্ধে নেওয়া হয়েছে আইনী ব্যবস্থা এবং বরখাস্ত করা হয়েছে চাকরি থেকে।
কী বলা যায় এ ঘটনাকে? ভূত তাড়ানোর সর্ষেতেই ভূত, নাকি রক্ষক যখন ভক্ষক? যেটাই বলা হোক ঘটনা একই। এ ধরনের ঘটনা যে এটাই প্রথম তা কিন্তু নয়। আমাদের রাষ্ট্রীয় প্রশাসনের ধাপে ধাপে এমন অনেক সোহেল বিশ্বাসের খোঁজ মাঝে-মধ্যেই পাওয়া যায়। একশ্রেণীর মানুষ অর্থবিত্তের লোভে অন্ধ হয়ে এমনসব ন্যাক্কারজনক ঘটনার জন্ম দেয় যে, মানুষ এমন কাজ করতে পারে তা বিশ্বাস করতেই কষ্ট হয়।
গ্রেফতার হওয়ার পরে সোহেল বিশ্বাসের কীর্তি-কাহিনী বের হয়ে এসেছে। খবরে বলা হয়েছে, চট্টগ্রাম কারাগারে বন্দীদের জন্য খাবার সরবরাহকারি বানিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যোগসাজশ ছিল তার। নিম্নমানের খাবার সরবরাহ, পরিমানে কম দেওয়া এবং প্রতি বছর একই প্রতিষ্ঠানকে কাজ পাইয়ে দেওয়ার বিনিময়ে মোটা অঙ্কের টাকা পেতেন তিনি। এ ছাড়া কারাগারের ভেতরে-বাইরে মাদক ব্যবসাসহ নানা অনিয়মেরও পৃষ্ঠপোষকতা ছিল তার। দিনের পর দিন দেদারচে তিনি এসব অপকর্ম চালিয়ে এলেও কোনো এক অদৃশ্য কারণে কর্তৃপক্ষের নজরে তা পড়েনি। অনেকেই বলছেন যে, সর্ষের মধ্যে ভূত শুধু চট্টগ্রাম কারাগারের সোহেলের ওপর ভর করেছিল, তা নয়, সে ভূতের আছর হয়তবা আরো উপরের দিকেও বিস্তার করা আছে। যে কারণে সোহেল বিশ্বাসকে অবৈধ কাজকর্ম চালিয়ে যেতে কোনোরকম বেগ পেতে হয়নি।
এদিকে গত ২৮শে অক্টোবর সমকালে প্রকাশিত এক প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, চট্টগ্রাম কেন্দ্রীয় কারাগারকে ঘিরে অবৈধ ব্যবসায়ের যে সিন্ডিকেট রয়েছে তার প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিলেন জেলার সোহেল রানা বিশ্বাস। এরই মধ্যে তিনি পরিণত হয়েছেন কোটিপতিতে। একই দিনে পত্রিকাটি আরেক ডেপুটি জেলার মোমিনুল ইসলামের ইয়াবা ব্যবসায়ে জড়িত থাকার খবর প্রকাশ করেছে। ঢাকার কেরাণীগঞ্জের কেন্দ্রীয় কারাগারে চাকরিরত থাকা অবস্থায় জনৈক কয়েদীর কাছ থেকে উদ্ধার করা ৫৯ পিস ইয়াবা তিনি এক মাদক ব্যবসায়ীর কাছে বিক্রি করে দিয়েছিলেন। এ বিষয়ে গঠিত তদন্ত কমিটি তদন্ত চালিয়ে অভিযোগের সত্যতা পেয়েছেন, মোমিনুলও এখন কারাগারে আছে।
দুর্নীতি আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রের বিভিন্ন স্তরে এমনভাবে জেঁকে বসেছে যে, অবস্থাটা দাঁড়িয়েছে ‘সর্বাঙ্গে ব্যাথা, মলম দেব কোথা’র মতো। কোথায় নেই অনিয়ম-দুর্নীতি? রাষ্ট্রের প্রতিটি অঙ্গে দুর্নীতি-অনিয়মের ঘা ক্যান্সারের মতো ছড়িয়ে পড়েছে। রাষ্ট্রের যারা কর্ণধার তারা নিয়মিতই দুর্নীতি অনিয়মের বিরুদ্ধে কঠোর বাক্য উচ্চারণ করে থাকেন, দুর্নীতিকে আর প্রশ্রয় দেয়া হবে না এমন আশ্বাসবাণীও আমরা হরহামেশা শুনতে পাই। কিন্তু শুধুই কি হুম্বিতুম্বি! দুর্নীতি তো কমছেই না, বরং দিন দিন এর প্রকোপ বাড়ছে।
সরকারি দফতরে ঘুষ-দুর্নীতি এখন আর গোপন কোনো বিষয় নয় ওপেন সিগ্রেট। প্রকাশ্যেই চলে লেন-দেন, কোনো কোনো দফতরে তো রীতিমত ঘুষের নির্ধারিত রেটও রয়েছে। সে রেটের নিচে দিলে কাজ তো হয়ই না, ভোগান্তি আরো বাড়ে। ঘুষ নিয়ে অনেক পুরানো একটি গল্পের কথা বলি, বৃটিশ আমলের কথা। সাবরেজিষ্ট্রি অফিসের ক্লার্ক ঘুষ চেয়েছে জমি রেজিষ্ট্রি করতে আসা এক লোকের কাছে, ক্ষুব্ধ লোকটি গিয়ে ইংরেজ সাব-রেজিষ্ট্রারকে বলল, ‘হি ইট ঘুষ স্যার, হি ইট ঘুষ।’ ইংরেজ সাহেব ঘুষ কী বোঝেন নাই। তিনি ক্লার্ককে জিজ্ঞেস করলেন, ‘হোয়াট ইজ ঘুষ?’ ক্লার্ক অফিসের বাইরের দোকান থেকে কতগুলো কলা এনে টেবিলে রেখে বলল, দিস ইজ ঘুষ স্যার। সাহেব একটি কলা ছিলে খেতে খেতে বললেন, ‘ঘুষ ইজ গুড ফর হেলথ’।
বাস্তবিকই ঘুষ ইজ গুড ফর হেলথ! আপনি যদি প্রচুর পরিমানে ঘুষ খেতে পারেন, তাহলে ওপর মহলকে একই কায়দায় ম্যানেজ করে চাকরিতে প্রমোশন পাবেন, ভালো জায়গায় পেস্টিং পাবেন। এর উল্টোটা হলে আপনাকে পড়ে থাকতে হবে অনেক পেছনে। আপনি যদি ঘুষ নামক মহাঘর্ষ বস্তুটিকে হস্তগত করতে পারেন, তাহলে আপনার স্ত্রী সন্তানকে বিলাসী জীবন-যাপন করাতে পারবেন, ছেলেমেয়েকে দেশ-বিদেশের নামী-দামী কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াতে পারবেন। আবার বনে যাবেন সমাজের একজন কেউকেটা। হাজারো লোক আপনাকে সালাম দেবে, সামনে প্রশংসার তুবড়ি ছোটাবে। কী ভাবছেন? আড়ালে আবডালে আপনাকে ঘুষখোর বলে গালি দেবে? দিক। তাতে আপনার তো কোনো ক্ষতি হচ্ছে না। আপনি ওই ঘুষের টাকার সদ্ব্যবহার করে সমালোচকদের মুখ বন্ধ করে দিতে পারবেন। চাই কি চাকরি থেকে অবসরে যাবার পর সারা জীবন বে-আইনী কাজ করে দেশের আইন প্রণেতাও হয়ে যেতে পারেন! বে-আইনী কাজ করে টাকা কামালে আইন প্রণেতা হওয়া যাবে না, এমন কোনো আইন তো আমাদের দেশে নেই।
আমাদের দেশটি দুর্নীতিতে ছেয়ে গেছে বা সবকিছু গ্রাস করেছে-এমন খোদউক্তি আমরা প্রায়ই শুনি। একে প্রতিহত বা নির্মূল করার কথাও শোনা যায় রথী-মহারথীদের মুখ থেকে। কিন্তু এর প্রকোপ কেন কমছে না? কেউ কেউ বলেন, এর শিকড় খুব গভীরে চলে গেছে। ডালপালা ধরে টান দিলে মূল বেরিয়ে আসতে পারে। আর তা বেরিয়ে এলে সৃষ্টি হতে পারে ভূ-কম্পন। যে কম্পনে অনেকের সাজানো গোছানো মান-সম্মান, প্রভাব-প্রতিপত্তির প্রাসাদ ভেঙে চুরমার হয়ে যেতে পারে ভাঙ্গা কাঁচের মত টুকরো টুকরো। আর সেজন্যই এর মূলোৎপাটনে তেমন আগ্রহ নেই কারো।
সরকারি প্রশাসনের মধ্যে পুলিশের বিরুদ্ধেই বেশি অভিযোগ শোনা যায়। রাষ্ট্রের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ এ সংস্থাটির কতিপয় অসাধু সদস্যের নৈতিকতায় এতোটাই অবক্ষয় সৃষ্টি হয়েছে যে, এদের কাছে সাহায্য চাইতেও এখন কেউ যেতে চায় না। এদের কারণেই সম্ভবত ‘বাঘে ছুলে আঠারো ঘা, পুলিশে ছুলে ছত্রিশ ঘা’ প্রবাদটির উৎপত্তি হয়েছে। নীতিহীন পুলিশের পাল্লায় যে একবার পড়েছে, সে বুঝেছে কত ধানে কত চাল। বুঝেছে রাজধানীর সেই তরুণীটিও, যে একটি প্রোগ্রাম সেরে মধ্যরাতে বাড়ি ফেরার পথে পুলিশের পোশাক পরা কয়েকজন দুর্বৃত্তের পাল্লায় পড়েছিল। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যম ফেসবুকে সে ঘটনা যারা দেখেছেন তারা বিস্ময়ে হতবাক হয়েছেন! রাষ্ট্রের একটি বিধিবদ্ধ বাহিনী, যার দায়িত্ব হলো নাগরিকদের জানমালের সুরক্ষা দেওয়া, সে বাহিনীর সদস্যরা যখন একজন তরুণীকে রাস্তায় একা পেয়ে উত্যক্ত করে, তখন বাকরুদ্ধ হওয়া ছাড়া আর উপায় কি? যারা ওই ভিডিও ক্লিপটি দেখেছেন তাদের কাছে ওই পুলিশগুলোকে বখাটে যুবকের প্রতিচ্ছবি বলেই মনে হয়েছে।
আইনশৃঙ্খলা বাহিনীতে কর্মরত কিছু কিছু ব্যক্তিদের মুখের ভাষা আর মানসিকতা যে এত নিম্নমানের হতে পারে, অনেকের তা ধারণায়ই ছিল না। পাশাপাশি ওই তরুণীর সাহসিকতা দেখে সবাই মুগ্ধও হয়েছেন। নৈতিকতা বিবর্জিত ওই পুলিশগুলোকে সে যে সাহসের সাথে মোকাবিলা করেছে, তাতে তাকে ধন্যবাদ না দিয়ে উপায় নেই স্যালুট বোন তোমাকে। আমরা ভেবেছিলাম, ঘটনাটি বোধহয় হাজারো ঘটনার নিচে চাপা পড়ে হারিয়ে যাবে। কিন্তু না? গত ২৯ অক্টোবরের একটি দৈনিকের খবরে জানা গেল, ফেসবুকে ভাইরাল হওয়া ওই ঘটনার তদন্ত করেছে পুলিশের উর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষ। আর তাতে ওই তরুণীকে উত্যক্তকারী তিন পুলিশ সদস্যের পরিচয় পাওয়া গেছে। তাদের বিরুদ্ধে বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণের সুপারিশও করা হয়েছে। পুলিশ তিনজন হলো-রামপুরা থানার এএসআই ইকবাল হোসেন এবং পাবলিক অর্ডার ম্যানেজমেন্টের (পিওএম) দুই কনস্টেবল মিজানুর ও তৌহিদ।
আমরা জানিনা এসব অনৈতিক মানসিকতার লোকগুলিকে পুলিশ বাহিনীতে রাখা হবে কিনা। এরা যে রাষ্ট্রীয় এই গুরুত্বপূর্ণ বাহিনীতে থাকার যোগ্যতা হারিয়েছে তা বলার অপেক্ষা রাখেনা। চট্টগ্রাম কারাগারের জেলার আর রামপুরা থানার ওই পুলিশেরা একই অপরাধে অপরাধী। একজন তার ক্ষমতার অপব্যবহার করে অনৈতিক পথে অর্থকড়ি কামিয়েছে, আর অন্যরা ক্ষমতার অপব্যবহার করে একজন অসহায় তরুণীকে বিপদে ফেলে হয়তো ভিন্ন কোনো বাসনা চরিতার্থ করতে চেয়েছিল। এদেরকে ক্ষমা করার কোনো সুযোগ নেই। এরা সমাজের শত্রু, মানবতার শত্রু। শুধু বিভাগীয় ব্যবস্থা গ্রহণই এদের জন্য যথেষ্ট নয়। প্রচলিত আইনে এদের দৃষ্টান্তমূলক শাস্তি দেয়া উচিত।
সুশাসনের কথা আমরা প্রায়ই শুনি। সুশাসনের জন্য কারো কারো কুম্ভীরাশ্রুও আমাদেরকে দেখতে হয়। কিন্তু সুশাসন আর আসে না। কেন আসে না তা ভেবে দেখা দরকার। সুশাসনের জন্য তো সু-মানুষ লাগবে। সমাজ, রাষ্ট্র ও সরকারের প্রতিটি স্তরে সু-মানুষদের স্থান করে দিতে হবে। তাহলেই দূর হবে সব অনাচার, অবিচার, ব্যাভিচার, দুর্নীতি, অনিয়ম ও জালিয়াতি। অন্যথায় আমরা শুধু হাপিত্যেশই করে যাব। সুশাসনের মুখ দর্শন কোনো কালেই সম্ভব হবে না।
জেল খানার জেলার সোহেল বিশ্বাস এখন জেলে। কিন্তু একজন সোহেল বিশ্বাসকে জেলে পুরে আমরা আমাদের এ সমাজকে কাঙ্খিত জায়গায় নিয়ে যেতে পারব না। এমন হাজারো সোহেল ছড়িয়ে এবং জড়িয়ে আছেন আমাদের সমাজ ও রাষ্ট্রের গুরুত্বপূর্ণ জায়গাগুলোতে। তাদেরকে চিহ্নিত করতে হবে, উচ্ছেদ করতে হবে সমাজ ও রাষ্ট্রের জমিন থেকে। যেমনিভাবে আগাছা তুলে ফেলে কৃষক তার জমিকে তৈরি করে উত্তম ফসল ফলানোর জন্য ঠিক তেমন ভাবে।
সূত্র: বিভিন্ন জাতীয় পত্রিকা, সাংবাদিক ও রাজনৈতিক বিশ্লেষক।
সাইবার নিউজ একাত্তর/ ২০ই এপ্রিল, ২০১৯ ইং/হাফিজুল
© কপিরাইট : খন্দকার মিডিয়া গ্রুপ
বাল্যবিবাহ রোধ করুন, মাদক মুক্ত সমাজ গড়ুন।