মঙ্গলবার, ০২ মার্চ ২০২১, ০৮:০৭ অপরাহ্ন
এ আর রুহুল আমিন হাজারী, (কুমিল্লা) দেবীদ্বার থেকে :
ঘাতক রিক্সা চালক মোখলেছ কর্তৃক ভয়ঙ্কর রক্তখেলায় আতঙ্কিত দেবীদ্বার উপজেলার রাধানগর গ্রামের জনপদে এখনো থমথমে বিরাজ করছে। দিনের আলোতে বাড়ির লোকজন খুব একটা দেখা না গেলেও পরিস্থিতি পর্যবেক্ষনে বিভিন্ন এলাকা থেকে আগত লোকজনের উপস্থিতি ছিল সীমিত। স্থানীয় বিদ্যালয়গুলোতেও শিক্ষার্থীর সংখ্যা কমে গেছে। শনিবার দুপুরে সরেজমিনে ওই এলাকায় যেয়ে এমন চিত্রই দেখা যায়।
ঘাতক মোখলেছের বাড়িতে কাউকে পাওয়া যায়নি। নিহত তিন পরিবারের বেঁচে থাকা কয়েকজন সদস্য ও স্বজনকে পাওয়া যায়। তাদের মধ্যে চরম আতঙ্ক, হতাশা ও ক্ষোভ দেখা যায়।
মৃত’ নাজমা বেগম (৪০)’র ঘরে যেয়ে দেখা যায় নাজমার ছোট ভাই ও হত্যা মামলার বাদী মোঃ রুবেল (২৪) বোনের শোকে কাতর, একটু পর পর চিৎকার করে বোনের পরিবারের ভবিষ্যৎ কি হবে তাই ভাবছেন আর বলছেন, কে এপরিবারের শিশুদের দায়িত্ব নেবে। সে উপজেলার জাফরাবাদ (মনিপুর) গ্রামের মোঃ তমিজ উদ্দিন ফকির’র পুত্র। তার ভগগ্নীপতি আহত রিক্সা চালক নূরুল ইসলামের অবস্থাও সংকটাপন্ন, কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি ৬ জনের মধ্যে আহত নূরুল ইসলামের মা’ মাজেদা বেগম (৬৫)’র অবস্থাও আরো সংকটাপন্ন। তাকে কুমেক হাসপাতালের ১৫নম্বর বেডে অক্সিজেন ও সেলাইন দিয়ে রাখা হয়েছে।
মামলার বাদী রুবেল চিৎকার করে বলেন, ঘাতক মোখলেছ পরিকল্পিতভাবে এ হত্যাকান্ড ঘটিয়েছে। এ পরিকল্পনার অংশিদার মোখলেছের স্ত্রী রাবিয়া বেগম (৩০), মোখলেছের ভাই মোহাম্মদ হোসেন, তার স্ত্রী জেসমিন আক্তার, অপর ভাই হারুনের স্ত্রী মরিয়ম বেগম। তাদেরকে মামলায় আসামী করা হয়নি। তাদের গ্রেফতার পূর্বক জিজ্ঞাসাবাদ করলেই সকল তথ্য পাওয়া যেত। তাদের পুলিশ আটক করলেও ছেড়ে দেয়, শুধু তাই নয়,- ঘাতক মোখলেছের স্ত্রী রাবেয়া হত্যা মামলার বাদী হয়ে উল্টো আমাদের হয়রানী করছে। আমরা মোখলেছের পরিবারকে ঘরে আটকে আগুনে পুড়িয়েছি এমন অভিযোগ নিয়েও পুলিশ আমাদের জিজ্ঞাসাবাদ করেছে, আগুনে পোড়া নয়, অক্ষত ঘর দেখিয়ে নিস্ক্রিতি পাই।
আহত রিক্সা চালক নূরুল ইসলামের বড় মেয়ে জান্নাত জানায়, তারা দুই ভাই ও দুই বোন। জান্নাত সকলের বড়, সে রাধানগর উচ্চ বিদ্যালয়ের দশম শ্রেনীর ছাত্রী, ছোট ভাই নাজমুল হাসান সপ্তম শ্রেনীর ছাত্র, চতুর্থ শ্রেনীতে পড়ে আবু নাঈম, সকলের ছোট বোন সানজিদা আক্তার পড়ে দ্বিতীয় শ্রেনীতে। এ অবস্থায় হাসপাতালে মৃত্যুর সাথে পাঞ্জালড়া পিতা আর দাদীকে হারালে পরিবারটির করুন পরিনতি দাড়াবে। জান্নাত আরো জানায়, তার মা’ সাত মাসের অন্তঃস্বত্বা ছিল। মায়ের গর্ভের সন্তান ছিল ছেলে। ঘাতকের রক্তখেলায় তার অনাগত ভাইটিও দুনিয়ার আলো দেখতে পেলনা। ঘটনার সময় আমি স্কুলে ছিলাম। আমার ছোট ভাই আবু নাইম তাকে স্কুল থেকে ডেকে আনে।
নিহত আনোয়ারা বেগম’র পরিবারের অবস্থা আরও করুন। আনোয়ারা বেগম(৪৫) ও তার ছোট ছেলে তালতলা সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়ের ৪র্থ শ্রেণীর ছাত্র আবু হানিফ(১০)কে নির্মমভাবে এলোপাথারী কুপিয়ে হত্যা করেছে ঘাতক মোখলেছ। এদৃশ্য প্রত্যক্ষ করেন নিহত আনোয়ারার ছোট মেয়ে নিপা আক্তার। প্রায় ৩ মাস পূর্বে নিপার পিতা ক্যান্সারে আকান্ত হয়ে মারা যান। লেখাপড়া ছেড়ে তার বড়ভাই সিএনজি চালক আলম(১৭) সংসারের হাল ধরেন। তার মা’ও তার বাবার রেখে যাওয়া বেল জালে মাছ ধরে সংসারের সহযোগীতা করতেন। নিপা মোহনপুর উচ্চ বিদ্যালয়ে নবম শ্রেণীতে বানিজ্য শাখায় পড়ে। মেধাবী এ ছাত্রীর লেখাপড়াও এখন বন্ধের পথে। পরিবারের সদস্যরা তাকে এ নাবালিকা বয়সেই বিয়ে দেয়ার কথা ভাবছেন। নিপার,মা- বাবা, ৪ বোন ও ২ ভাইয়ের সংসার এখন ফাঁকা। নিপার বড় তিন বোন শিউলি, আকলিমা, কুলসুমের বিয়ে হয়ে গেছে। ওরা থাকেন স্বামীর বাড়িতে।
নিপার বড়বোন শিউলি, আকলিমা, কুলসুম জোর দাবী জানিয়ে বলেন, মোখলেছের মস্তিষ্ক বিকৃত ছিলনা, সুস্থ্য ছিল। ঘটনার আগের রাতে তার বাড়িতে ৪জন নারী পুরুষ এসেছিল, ওরা কারা কি কারনে এসেছিল? হত্যাকান্ড সংগঠনের পূর্বে অর্থাৎ ওই সকালে তার সাথে বোরখা পরিহিত মহিলাটি কে ছিল ? এছাড়া হত্যাকান্ডের পূর্বে পূর্ব পরিকল্পনানুযায়ী দোকানে দা’য়ের অর্ডার কেন দিয়েছিল? দা’ নিয়ে আসার পথে অনেকের সাথে ভালো ব্যবহার কিভাবে করল? এ বিষয়গুলো জানত ঘাতক মোখলেছের স্ত্রী, ভাই ও দুই ভাইয়ের স্ত্রীকে জিজ্ঞাসাবাদ করলেই সত্য বেড়িয়ে আসবে। শিউলি জানায়, ভুল করে মোখলেছ তার ছোটভাই মোহাম্মদ হোসেন’র মেয়ে ফাহিমাকে কুপিয়েছিল। তাই তার বাবা হোসেন ক্ষুব্ধ হয়ে কুমেক হাসপাতালে তার ভাবী রাবেয়াকে তিরষ্কার করে বলেন, তোমার স্বামীর রাতের তর্ক-বিতর্ক শোনেছি। তোমার কাছে জমা রাখা ৩লক্ষ টাকা ফেরত না দেয়ার কারনেই সে ক্ষুব্ধ হয়ে এ নারকীয় তান্ডব চালিয়েছে। শিউলি জানায় ওই টাকার উৎস কি? তা জানা প্রয়োজন। তবে তাদের এসব অভিযোগের সুনির্দিষ্ট এবং প্রত্যক্ষদর্শি পাওয়া যায়নি। তাছাড়া কেউ মুখ খুলতে চায়না। সবাই আতঙ্কে নিজেদের আড়াল করে রেখেছেন।
এছাড়া ঘটনার ৪ দিন পরও রাধানগর বাসীর আতঙ্ক কাটেনি। ভয়ে- আতংকে স্কুলগুলোতে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি কমেগেছে এমন সংবাদে শনিবার দুপুরে সরোজমিনে একটি হাই স্কুল ও দুটি সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে গিয়ে দেখা যায় শিক্ষার্থীদের উপস্থিথি অনেক কম। শিক্ষার্থীদের অনুপস্থিতির কারনে (আজ রোববার) থেকে শুরু হওয়া পঞ্চম শ্রেনীর মডেল টেষ্টে পরীক্ষা নিয়েও শিক্ষকরা রয়েছেন খুবই উদ্বগ্নি। তাই শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয় মুখি করতে শিক্ষকরা যোগাযোগ করছে অভিবাবকদের সাথে। রাধানগর সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পঞ্চম শ্রেনীতে ৩২ জন ছাত্রছাত্রীর মধ্যে উপস্থিত পাওয়া যায় ১৭জনকে, চতুর্থ শ্রেনীর ৩৬ জনের মধ্যে ৭জন, তৃতীয় শ্রেনীর ৩৪ জনের মধ্যে ৩জন, দ্বিতীয় শ্রেনীর ৩৮জনের মধ্যে ১জন, প্রথম শ্রেনীর ৩৩ জনের মধ্যে ৬জন, শিশু শ্রেনীতে ২৭জনের মধ্যে ৩জন উপস্থিত ছিলো। অপর দিকে ছেচড়াপুকুড়িয়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ে পঞ্চম শ্রেনীতে ৩২জনের মধ্যে ১০জন, চতুর্থ শ্রেনীর ৩১ জনের মধ্যে ৯জন, তৃতীয় শ্রেনীর ২৫ জনের মধ্যে ১১জন, দ্বিতীয় শ্রেনীর ২২জনের মধ্যে ১২জন, প্রথম শ্রেনীর ২৫জনের মধ্যে ৫জন, শিশু শ্রেনীতে ২২জনের মধ্যে ১জন শিক্ষার্থী উপস্থিত পাওয়া যায়। রাধানগর উচ্চ বিদ্যালয়েও শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি ছিলো অনেক কম।
রাধানগর উচ্চ বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোঃ রকিব আহসান ভূইয়া বলেন, এমনিতেই ছেলে ধরা আতংকে স্কুলে শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি কমে যায়, এসব গুজবে কান না দিতে বলে শিক্ষার্থীদের যখন স্কুল মুখি করছিলাম, ঠিক সেই মুহুর্তে এমন লোমহর্ষক হত্যাকান্ডের ফলে শিক্ষার্থীসহ এলাকাবাসীরা স্তম্ভিত হয়ে যায়। এই হত্যাকান্ড ও পরবর্তীতে ঘাতকের স্ত্রীর কর্তৃক অজ্ঞাত দেড় হাজার লোকের বিরুদ্ধে দায়ের করা মামলার কারনে মানুষজন আতংকের মধ্যে রয়েছে, তবে পুলিশের পক্ষ থেকে কোন প্রকার হয়রানি করা হচ্ছেনা।
ছেচড়াপুকুড়িয়া সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়ের প্রধান শিক্ষক মোঃ মামুনুর রশিদ জানান, বিদ্যালয়ে শিক্ষার্থীদের অনুপস্থিতির কারনে আমরা খুবই উদ্বগ্নি। আতংকিত না হয়ে শিক্ষার্থীদের বিদ্যালয়ে পাঠাতে অভিবাবকদের অনুরোধ করেও লাভ হচ্ছেনা। (আজ রোববার) পঞ্চম শ্রেনীর শিক্ষার্থীদের মডেল টেষ্ট পরীক্ষা শুরু হচ্ছে, আমারা তাদের বাড়ি বাড়ি যাচ্ছি এবং তাদেরকে পরীক্ষায় অংশগ্রহন করতে বুঝাচ্ছি।
দেবীদ্বার উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা রবীন্দ্র চাকমা জানান, আতংকিত না হতে ঘটনাস্থলে গিয়ে আমরা এলাকাবাসীকে বুঝিয়েছি এবং কোন প্রকার গুজবে কান না দিতে শিক্ষার্থী ও অভিবাবকদের বুঝানোর জন্য আমরা শিক্ষকদের নির্দেশনা দিয়েছি। শিক্ষকরা সেই ভাবে কাজ করছে, আশা করি দুই এক দিনের মধ্যেই শিক্ষার্থীরা স্কুল মুখি হবে। এছাড়াও পার্শ্ববর্তী কুরুন সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়, মোহনপুর উচ্চ বিদ্যালয়, প্রাথমিক বিদ্যালয় সহ সারা উপজেলায়ই শিক্ষার্থীদের উপস্থিতি কমে গেছে।
উল্লেখ্য গত বুধবার সকাল দশটার দিকে রাধানগর গ্রামের মুর্তুজ আলীর ছেলে রিক্সা চালক মোখলেছুর রহমান একটি ধারালো দা ক্রয় করে বাড়ীতে এসে আকস্মিক লোকজন এলোপাতারি কুপিয়ে রক্তের হলিখেলা শুরু করে। এতে হতাহত লোকজন বিকৃত অবস্থায় ছড়িয়ে ছিটিয়ে মাটিতে পড় থাকতে দেখা যায়। এ সময় প্রতিবেশী নুরুল ইসলামের স্ত্রী নাজমা আক্তার (৪০), মৃত শাহ আলমের ছেলে আবু হানিফ (১০) এবং স্ত্রী আনোয়ারা বেগম আনু (৪৫) ঘটনাস্থলেই মারা যান। ওই সময় ঘাতক মোখলেছের দায়ের কুপে আব্দুল লতিফ(৪৫), মাজেদা বেগম(৬৫), নুরুল ইসলাম(৫০), রাবেয়া বেগম(৪০), ফাহিমা(১০), জাহানারা বেগম(৫০), লোকমান(১৭) সহ আরো ৭জন আহত হয়। লোকমান ছাড়া বাকী ৬জনকে কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়। এ সময় ঘাতকের রক্ত খেলার তান্ডব লীলা দেখে স্থানীয় লোকজন মসজিদের মাইকে ঘোষণা করলে বিপুল সংখ্যক জনতা ঐক্যবদ্ধ হয়ে তাকে আটক করে গণপিটুনী দেয়। এতে ঘটনাস্থলেই ঘাতক মোখলেছ মারা যায়।
সাইবার নিউজ একাত্তর/ ১৩ জুলাই, ২০১৯ ইং/হাফিজুল
© কপিরাইট : খন্দকার মিডিয়া গ্রুপ
বাল্যবিবাহ রোধ করুন, মাদক মুক্ত সমাজ গড়ুন।